ভুলু – একটা লাল কুকুরের নাম

বর্তমান ওসমানী মিলনায়তনের পেছনে ছোট খাটো একটা ডোবা বা পুকুর ছিলো। মেতরেরা প্রতিদিন সকালে প্রতিটা বাড়ির টয়লেটের নীচে রাখা বালতিতে জমানো মানুষের বর্জ্য একসাথ করে ঐ ডোবা বা পুকুরে ফেলতো।
দক্ষিনে রেলওয়ে হাসপাতাল (বর্তমানে সরকারী কর্মচারী হাসপাতাল), পূবে ওয়ার্কসপ, পশ্চিমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল, ফজলুল হক হল আর উত্তরে খাদ্য ভবন ও সচিবালয়ের রাস্তা – এর মাঝখানটায় উঠোন ওয়ালা বাড়িগুলো ছিলো রেলওয়ে কলোনী হিসেবে। সেখানে ভাড়া থাকতাম।
সেইখানে একটা স্কুল ছিলো। আমি ক্লাস সিক্সে পড়ি। টিফিন পিরিয়ডে বন্ধুরা মিলে বল খেলতাম। কতোবার যে সেই গুয়ের পুকুরে বল পড়েছে তার ইয়াত্তা ছিলো না। সেই দিনগুলো আজ কোথায় হারিয়ে গেলো!
তখন প্রায় দুপুর কোনো এক ঈদে আমরা ছোট ছোট বন্ধুরা দৌড়ঝাপ খেলাধুলা করছি এমন সময় একটা লাল কুকুরকে দেখি। কুকুর দেখলে যেমনটা করবার কথা আমরা বন্ধুরা তাই করেছি – কুকুরকে ধাওয়া দিয়েছি। তারপর ভুলে গেছি লাল কুকুরটার কথা।
সন্ধ্যে বেলা – হঠাত দেখি কুকুরটা আমাদের বাড়ির গেটের কাছে। আমার বাবা কুকুরটাকে ডাক দেয়াতে বাড়ির ভেতরে চলে আসে। ঈদের কিছু খাবার কুকুরটাকে দেয়া হয়। এরপর আমার বাবা একটা ব্লেড দিয়ে গলায় বাঁধা ছিঁড়ে আসা দড়িটা কেটে দেন। রাতে কুকুরটা আমাদের বাড়ির উঠোনেই থেকে যায়।
আমার বাবা খাদ্য ভবনে চাকুরী করতেন। তখন অফিস আওয়ার শুরু হতো সকাল সাড়ে সাতটায়। বাসার কাছেই অফিস। হেটে যেতে তিন চার মিনিটের রাস্তা। এবার থেকে লাল কুকুরটা আমার বাবাকে অফিস পর্যন্ত পৌঁছে দেবার দায়িত কাঁধে নিয়ে নেয়। দেখেই মনে হতো কুকুরটা বেশ শক্তিশালী ছিলো। গলার দড়িটা কেটে দেয়াতেই এতোটা আনুগত্য?
আমরা কুকুরটাকে নাম দিলাম ভুলু। এই নামে ডাকলে সাড়া দিতো। কিভাবে যেনো বুঝে গিয়েছিলো যে এটাই এখন থেকে ওর নাম।
ভুলু আমাদের খেলার সাথী হয়ে গেলো।
আমাদের একটা লাল রঙের বেড়ালও ছিলো, নাম পুষি। ছিলো একটা টিয়া পাখিও, মিঠু। পুষি কখনো ভুলুকে দেখে ভয় পেতো না। ভুলুও পুষিকে কখনো আক্রমন করেনি। মিঠুও ভুলু ও পুষির বন্ধুই ছিলো। কেউ কাউকে কখনোই আঘাত করেনি।
পুষির সাথে ভুলুর বন্ধুত্ব ছিলো আরো একধাপ এগিয়ে। পুষি সন্ধ্যার পর বাড়ির বাইরে গেলে অন্য কুকুরেরা যখন ধাওয়া দিতো তখন দৌড়ে বাড়িতে এসে ভুলুকে সাথে করে নিয়ে বের হতো। ভুলু সব কুকুরকে তাড়িয়ে দিয়ে বীর দর্পে ঘরে ফিরে আসতো।
ভুলু কোনো ট্রেইনিং প্রাপ্ত কুকুর ছিলো কিনা জানা ছিলো না। ভুলুর আত্মসম্মান বলে একটা ব্যাপার ছিলো। আমরা যেভাবে ইচ্ছে ভুলুর সাথে ব্যবহার করতে করতে পারতাম। একদিন কি যেনো একটা ভুলের জন্য আমার বাবা ভুলুকে অনেক মেরেছিলো – ভুলু একদম প্রতিবাদ করেনি। মার খেয়ে আমাদের ছেড়েও চলে যায়নি।
কোনো একদিন সকাল বেলায় আমার এক বন্ধু আমাদের বাসায় আসে। বাড়ির উঠোনে ভুলু তখন শুয়ে শুয়ে রোদ পোহাচ্ছিলো। বন্ধুটি পা দিয়ে ভুলুকে আদর করে দিচ্ছিলো। ঠিক তখন ভুলু হালকা গর্জে ওঠে। আমি বন্ধুকে নিষেধ করে বলি যে পা দিয়ে আদর না করে হাত দিয়ে যেনো করে। বন্ধুটি আমার কথা না শুনে আবারও পা দিয়েই আদর করতে থাকে। এবারও ভুলু আরেকটু উচু স্বরে গর্জে ওঠে। আমি বন্ধুকে নিষেধ করি। সে নিষেধ অমান্য করে যেই না তৃতীয়বার পা দিয়ে আদর করতে যায় তখনই দুই পা আমার বন্ধুর ঘাড়ে তুলে দিয়ে ভীষন ভয় দেখায়। আমার বন্ধু এতোটাই ভয় পেয়ে যায় যে সে আর কোনোদিন ভুলুর ভয়ে আমাদের বাসায় আসেনি।
ভুলু বাইরে গেলে অনেকেই মারার ভঙ্গি করেছে বা ঢিল ছুড়েছে এবং এসবের কারনে পরবর্তীকালে এলাকায় ভুলুকে নিয়ে একটা গুরুতর সমস্যা তৈরী হয়। সমস্যাটা হচ্ছে যে ভুলে ওদের চেহারা মনে রেখেছিলো এবং ওদের দেখতে পেলেই দৌড়ানি দিতো। যেহেতু এলাকার বেশিরভাগ মানুষই ভুলুকে কোনো না কোনোভাবে বিরক্ত করেছে সেহেতু এলাকার লোকজন ভুলুর ভয়ে বাসা থেকে বের হতে ভয় পেতো।
এর থেকে পরিত্রান পাবার জন্য এলাকার লোকজন সিদ্ধান্ত নেয় যে ভুলুকে মেরে ফেলবে। দুপুরের দিকে সবাই লাঠিসোট, দা, শাবল নিয়ে বাড়িতে হাজির। কিভাবে কিভাবে যেনো ভুলু ওদের সবার হাত থেকে বেঁচে বেড়িয়ে যায়। এবার এলাকার মানুষের আরো ভয় বেড়ে যায়। মজার ব্যাপার হলো আমাদের ভুলু কিন্তু কোনোদিন কাউকে কামড়ায়নি – শুধু ধাওয়া দিয়েছে।
১৯৭৯ সালে আমার বাবা মিরপুর-১৪ তে সরকারী কোয়ার্টার পায়। সেপ্টেম্বরের দিকে আমরা মিরপুরে চলে আছি। আসার সময় ভুলুকে ঐ একালার একজনকে দিয়ে আসি। উনি ভুলুকে তার দেশের বাড়ি রাজশাহিতে নিয়ে যাবেন।
ভুলুকে আমি আজও ভুলিনি। আমার এখনো মনে হয় হয়তো ভুলু বেঁচে আছে। শুধু গলার বাঁধন কেটে মুক্ত করে দেয়াতে এতোটা প্রভুভক্তি ভুলু কেনো দেখিয়েছিলো আজও ব্যাপারটা বুঝতে পারিনা। ও কুকুর ছিলো বলেই কি?
ভুলু – একটা লাল কুকু্রের নাম, আমার ভালোবাসা!

Hi, I’m Alam — a mathematician at heart who’s passionate about numbers, technology, and creative problem-solving. I also enjoy writing stories and poems in my free time.